গল্প- ওকি ধুনকর ভাই…

ওকি ধুনকর ভাইআই…

-পরিতোষ ভৌমিক 

 

গত ক’বছর শীতের তেমন দাপট দেখা যায়নি। আসছি আসছি করে একটু আধটু আলতো ছোঁয়া গায়ে মাখিয়ে ডিসেম্বরেই টাটা বাই বাই বলেছে।কবে শীত এল আর কবে গেল এই বুঝতে বুঝতে দিন চলে গেল। গত বছরতো আমার খেজুরের রস খাওয়াও হল না, ভাগ্যিস গিন্নী একদিন চালের গুঁড়ির রুটি খাইয়েছিল। এবছর অবশ্য অন্য কথা। হেমন্তেই শীতের সুন্দর আবেশ মাখা পরশ পেয়ে গা ফুরফুরে হয়ে গেছে।

চারিদিকে গন্ধরাজ, মল্লিকা, কামিনী ফুলের গাঁয়ে ভোরের শিশির বিন্দু এবং তার উপড়ে সকালের সোনালী রোদের স্বর্নালী আভায় মন মাতিয়ে তোলে, ইচ্ছে করে পাতায় পাতায় কবিতা লিখতে। এ সময়ে বকফুলের বড়া পাতে না পরলে আমার জমে না। সেই সাথে নবান্নের ধান ভানার গান, তাল সব কিছুই আমাকে দোলা দেয়। আদিখ্যেতা মনে হলেও এটাই বাস্তব, আমি হেমন্তকে খুব বেশী ভালবাসি, এই হেমন্তকাল চিরদিন আমাকে হাতছানি দেয় তার অমোঘ মোহময়তায়। শীতের কথা বলতে বলতে হেমন্তের গুন গান অনেক হল এবার আসা যাক কাজের কথায়। বলছিলাম মাস দেড়েক আগের কথা, সেদিন সকালে পড়াতে গেছিলুম টুম্পাদের বাড়িতে। টুম্পার ছোট ভাই ভারি দুষ্ট কিন্তু পড়াশোনায় খুব ভাল, তাই আমাকে শুধু সামনে থেকে তাকে মনযোগী রাখতে হয়, এর বাইরে খাটাখাটুনি খুব একটা বেশী না ফলে আমি কিন্তু প্রায়ই অমনযোগী হয়ে পড়ি। সেদিন পড়াতে পড়াতে হঠাৎ বাইড়ে নজর গেলে দেখতে পাই, দু-জন ধুনকর সবে বিছানা পাতছে, তখনো টুং-টাং শুরু হয়নি, টুম্পা বাড়ান্দায় পিঁড়ি পেতে বসে আছে ।সামনে এক থালা পান্তা, পেঁয়াজ আর শুকনো লঙ্কা পুড়া। ধুনকর দু’জনের মধ্যে তাদের প্রচলিত বিহারী ভাষার কথা বার্তা বুঝতে না পারলেও এতটুকু আন্দাজ করতে পারলাম, তাদের সম্পর্কটা খেয়াল মশকরার সম্পর্ক, অন্তত বাপ-বেটা বা কাকা –ভাতিজার নয়।ধুনকররা তাদের স্বভাব সিদ্ধ ভাবেই লুঙ্গি মুরি দিয়ে বসে সামনে ছোট পাহাড়ের মতো এক স্তূপ তোলা নিয়ে টুং টাং তালে তুলো ধুনতে শুরু করেছে। ছোট ছেলেটার বয়স আনুমানিক কুড়ি একুশ হবে, তালে তালে চোখ তার উঠানামা করছে বাড়ান্দায় বসা টুম্পার থালে-গালে। দেখতে তেমন সুঠাম দেহের মালিক না হলেও বেশ হৃষ্ট পুষ্ট চেহারা, একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের মধ্যে একটা বিরাট মায়া মায়া ভাব। বসার ভঙ্গিমায় একটা আভিজাত্য রয়েছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পাশের সহকর্মীকে যে তার নিজস্ব ভাষায় রাজকীয় ভাবে আদেশ নির্দেশ করছে আবার একটা অন্যরকম ভাল লাগার কথার ঈঙ্গিত দিচ্ছে তা কিন্তু আমি খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছিলাম। আর বুঝতে পারছিলাম বলেই যেন আমার মনযোগ আরো বেড়ে গেল। হালকা শীতের আবেশ মাখা সুন্দর সকালের এই দৃশ্য আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলাম। না আমি এর মধ্যে কোন দোষ দেখতে পাইনি। কেননা টুম্পা ষোড়শী, সুন্দরের বর্ণনা করলে টবে ফুটন্ত গাঁদা ফুল যেমন রূপের আলোর রোশনাই ছড়ায়, পান্তার সামনে বসা টুম্পার আনমনা চাহনি দেখে সে কথাই বার বার মনে পড়ছিল। প্রকৃতির কাছে আমরা প্রত্যেকে নত মস্তিষ্ক। না সেদিন আমি আর বেশীদূর এগোতে পারিনি, কেননা ততক্ষণে আমার বরাদ্দ সময় শেষ।

এ সময়ে ধুনকরদের প্রচুর আনাগোনা থাকে। আমাদের দেশে চিরাচরিত ভাবে বিহার রাজ্য থেকে এই সমস্ত ধুনকরেরা এসে বাসা বাঁধে, ঘর ভাড়া করে দল বেঁধে থাকে, রাতে হৈ হুল্লুর করে রান্না বান্না করে, হিন্দি বিহারী গান গায় আবার সকাল হলেই যে যার মতো বাইসাইকেলে ধুনা যন্ত্র বেঁধে বেরিয়ে পড়ে অলিতে গলিতে, ধুনা যন্ত্রে টং টং শব্দ করে হাঁক ছাড়ে, যে বাড়িতে ডাক পড়ে বিছানা পেতে বসে যায়। আধা বাংলার কথাগুলো শুনতে আমরা খুব মজা পাই, বেশীর ভাগ ধুনকর সরল সোজা প্রকৃতির হয়, আমাদের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় চলে। দূর দেশ থেকে আসে বলে কি না জানিনা, এরা হীনমন্যতায় ভোগে, আমাদের সঙ্গে সামাজিক ভাবে কোনদিন সমান সাজুস্যে চলার কথা ভাবেও না। ওদের এই দূরত্ব আমাকে কাছে টানে, আমি প্রায়ই ওদের সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করি; বাইরে থেকে দু’একজনের সঙ্গে ঘনিষ্টতা তৈরী হলেও আন্তরিক ভাবে কতটা কাছে যেতে পেরেছি জানিনা। তবুও ওদের দেশের বাড়ির জীবন যাপন, কৃষ্টি, রীতি-নীতি ইত্যাদি জানার কৌতূহলী বলেই আমি জানতে পেরেছিলাম, সেদিনের টুম্পাদের বাড়ির উঠানে দেখা ছেলেটার নাম রোশন। রোশনদের বাড়ি বিহারের একেবারে বদ্ধ গাঁয়ে। রাজধানী পাটনা থেকে ওদের বাড়িতে যেতে প্রায় ছাপ্পান্ন ঘণ্টার জার্নি। বাড়িতে মা বাবা ছাড়াও একটা বিধবা বোন রয়েছে। বাবা একফালি জমি নিয়ে পড়ে থাকে, কাজের খোঁজে আর দশ জন গ্রামের মানুষের মতোই ছোট বোনের জামাইয়ের সাথে রাজ্যান্তরী হয়েছে সে। গত বছরও ছিল, এবার একটু আগে থেকেই চলে এসেছে। ভগ্নীপতির সাথে খুব সুন্দর সম্পর্ক। ছেলে হিসেবে রোশন খুব ভদ্র, গরীব ঘরের ছেলে অথচ কথা-বার্তায়, চাল চলনে সব সময়েই অন্য দশজন বিহারীদের থেকে সে আলাদা। চোখে বিরাট স্বপ্ন, খুব সুন্দর গানের গলা। আমরা রাতের বেলায় প্রায়ই যে গানের জলসা শুনি, বেশীর ভাগ গান রোশনের গলা থেকেই বেরোয়। মোবাইলে সারেগামাপা অনুষ্ঠান দেখে সেখানে অংশগ্রহণ করার কথা মাঝে মধ্যে বলে বৈকি এখনো সে সাহস যোগাড় করে উঠতে পারেনি। তবে একদিন সে সেখানে যাবেই, এটাই তার প্রতিজ্ঞা।

হেমন্তের প্রভাব শেষ, শীত জাঁকিয়ে বসেছে। চারিদিকে সকাল বিকেল রাতে অগ্নিস্তুপের চারপাশে অলস মানুষের ভিড়, কূয়াশার চাদরে ঢাকা সকাল বেলায় গাছের মধ্যে বাঁদরের মতো কোমরে কলসি বাঁধা লোক ঝুলে থাকে, নেমে এসে হাঁক পারে “রস খাবেন রস…খেজুরের রস”, দাওয়ার পাশে মাটির ঊনানে রমণীরা ঘোমটা মাথায় পিঠে বানায় সেই সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ভাঙ্গা বাই সাইকেলের কড়কর আওয়াজের সাথে ধুনা যন্ত্রের টং টং তাল সঙ্গে চেনা সূর ,”লেপতোশক বনাইবেন………”। প্রতি দিনের মতো আজও এই চেনা সকালে আমি ছিলেম লেপের আড়ালে হঠাৎ করে একটা চিৎকার চ্যাঁচাম্যাচিতে ঘুম ভাঙ্গল, খেয়াল করে দেখলাম পশ্চিম দিকে অর্থাৎ টুম্পাদের বাড়ির দিকে। হৈচৈ ধীরে ধীরে বাড়ছে দেখে গাঁয়ে কম্বল জড়িয়েই এগিয়ে গেলাম, দূরত্ব একেবারে কম না হলেও গ্রামের রাস্তা তাই যেতে যেতে আরোও কয়েকজন সঙ্গী পেলাম এবং ঘটনার বিষয়ে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত ধারনাও পেলাম । গন্তব্যে পৌঁছে যেটুকু আবিষ্কার করতে পাড়লাম তা হল, টুম্পাকে পরশু রাত থেকে পাওয়া যাচ্ছে না । টুম্পার মা বাবা সহ পরিবারের ধারণা টুম্পা ধুনকর রোশনের সঙ্গেই পালিয়েছে তাই তারা এখন আজকে এদিকে আসা অন্য দুইজন ধুনকরকে আটকে রোশন সম্পর্কে জানতে চাইছে এবং এ নিয়ে দু-একজন অত্যুতসাহী যুবক ওদেরকে কিছু উত্তম মধ্যমও দিয়েছে । আমি এগিয়ে গিয়ে বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে পরিষ্কার করার জন্য আটক দুই ধুনকরের কাছ থেকে প্রথমে রোশনের মোবাইল নাম্বার নিয়ে স্যুইচ অফ পেয়ে পরে রোশনের ভগ্নীপতির নাম্বার নিয়ে ফোন করে জানতে পাড়লাম, ঘটনা সত্যি। গত পরশু রোশন টুম্পাকে নিয়ে মোম্বাইএর উদ্দ্যেশে পাড়ি দিয়েছে। ভগ্নীপতি একথা জানতে পেরে ভয়ে গতকাল বাড়ির উদ্দ্যেশে ট্রেন ধরেছে। টুম্পার সাথে নাকি তার মায়ের অনেক স্বর্ণালঙ্কার রয়েছে।

তবে কি টুম্পা রোশনের স্বপ্ন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে এ কদিনে! আরো অনেক অনেক প্রশ্ন মনে জাগছে। স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য কত মানুষ কত রকম ভাবে খাটে, রোশন কি সে স্বপ্নের কথা টুম্পাকে জানাতে পেরেছিল! টুম্পা কি রোশনের কন্ঠের জাদুতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল! নাকি বয়সের রসায়নে নিছক প্রেমের গল্প ওদের দু’জনের জীবনে! অনেক প্রশ্নের জবাব হয়ত সময় দেবে, আগামীকালের সুর্যোদয় টুম্পা রোশনের জীবনের কোন দিক আলোকিত করবে এ ধারণা বহন করা দুঃসাধ্য তবে স্বপ্ন সুখের সন্ধানে দুই রাজ্যের দুটি পরিবারকে এক সুতোয় বেঁধে টুম্পা রোশন এখন যে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপাড়ে ভালবাসার নির্জন দ্বীপে নিজেদের টেনে নিয়ে গেছে সেকথা বলাই বাহুল্য। তবে কি টুম্পা গত বছর থেকেই “ওকি গারিয়াল ভাই…” সুরে পথ চেয়ে ছিল রোশনের এ বছরের ফিরে আসার পন্থের পানে!

Loading

2 thoughts on “গল্প- ওকি ধুনকর ভাই…

Leave A Comment